মাসিক বন্ধ হচ্ছে না কেন?

মাসিক বন্ধ হচ্ছে না? টেনশন নয়, কারণ জানুন!

আচ্ছা, মাসিক নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটা খুবই স্বাভাবিক, তাই না? প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট সময়ে মাসিকের হওয়ার কথা, কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে মনে নানা প্রশ্ন জাগে। “মাসিক বন্ধ হচ্ছে না কেন?” – এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই আপনার মনেও এসেছে। আমি আজ আপনাদের সাথে এই বিষয় নিয়েই খোলামেলা আলোচনা করব। কোনো ভনিতা নয়, একদম সরাসরি কথা!

সুচিপত্র

মাসিক বন্ধ না হওয়ার পেছনের কারণগুলো

মাসিক বন্ধ না হওয়ার পেছনের কারণগুলো

মাসিক বন্ধ না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, তার মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ আলোচনা করা যাক:

গর্ভধারণ (Pregnancy)

মাসিক বন্ধ হওয়ার সবচেয়ে পরিচিত কারণ হলো গর্ভধারণ। যদি আপনার মাসিক নিয়মিত না হয়ে থাকে এবং আপনি সম্প্রতি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

যদি আপনার মনে সন্দেহ থাকে, তাহলে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। আজকাল বাজারে অনেক ধরনের প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট পাওয়া যায়, যা সহজেই ব্যবহার করা যায়।

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ

জীবনে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু অতিরিক্ত স্ট্রেস আপনার শরীরের অনেক কিছুই পরিবর্তন করে দিতে পারে। এর মধ্যে মাসিকও একটি। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যার ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করুন। যোগা, মেডিটেশন, বা পছন্দের গান শোনা – যা আপনাকে শান্তি দেয়, তাই করুন।

ওজন পরিবর্তন

অতিরিক্ত ওজন বাড়া বা হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া – দুটোই আপনার মাসিকের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। অতিরিক্ত ওজন বাড়লে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হয়, যা মাসিকের সমস্যা তৈরি করতে পারে। আবার, হঠাৎ করে ওজন কমে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়, যার কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।

স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন। ধীরে ধীরে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন, যাতে শরীরের ওপর বেশি চাপ না পড়ে।

পিসিওএস (PCOS)

পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম) একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যা অনেক নারীর মাসিকের ওপর প্রভাব ফেলে। পিসিওএস থাকলে ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি হয়, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এর কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে, বন্ধ হয়ে যেতে পারে, অথবা অতিরিক্ত রক্তপাতও হতে পারে।

পিসিওএস থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। ডাক্তার আপনাকে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিতে পারেন।

থাইরয়েড সমস্যা

থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে হরমোনের উৎপাদন অন্যতম। থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। থাইরয়েড বেশি বা কম কাজ করলে – দুটোই মাসিকের সমস্যা তৈরি করতে পারে।

থাইরয়েড সমস্যা সন্দেহ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেলে অনেক সময় মাসিকের পরিবর্তন হতে পারে। কিছু পিল মাসিকের রক্তপাত কমিয়ে দেয়, আবার কিছু পিল খেলে মাসিক বন্ধও হয়ে যেতে পারে। পিল শুরু করার প্রথম কয়েক মাসে এটা স্বাভাবিক, তবে দীর্ঘদিন ধরে পিল খাওয়ার পরেও যদি মাসিক না হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি

সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের মেনোপজ হয়। মেনোপজের সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মেনোপজের আগে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে, অর্থাৎ কখনো বেশি রক্তপাত হতে পারে, আবার কখনো একেবারেই বন্ধ থাকতে পারে।

অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা

কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন – ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বা কিডনির সমস্যা থাকলে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। এছাড়া, কিছু ওষুধ, যেমন – কেমোথেরাপি বা স্টেরয়েড, মাসিকের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

যদি আপনার অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে এবং মাসিকের সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

মাসিক বন্ধ না হলে কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

মাসিক বন্ধ হওয়া নিয়ে কখন চিন্তা করতে হবে, তা জানা জরুরি। নিচে কিছু পরিস্থিতি উল্লেখ করা হলো, যখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  • যদি আপনার বয়স ৪৫ বছরের কম হয় এবং ৩ মাসের বেশি সময় ধরে মাসিক বন্ধ থাকে।
  • যদি আপনার মাসিক নিয়মিত ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে অনিয়মিত হয়ে গেছে।
  • যদি মাসিকের সাথে অস্বাভাবিক ব্যথা বা অতিরিক্ত রক্তপাত হয়।
  • যদি আপনি গর্ভবতী হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং মাসিক অনিয়মিত হওয়ার কারণে সমস্যা হচ্ছে।
  • যদি আপনার পিসিওএস বা থাইরয়েডের মতো কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে।

মাসিক নিয়মিত করতে কিছু ঘরোয়া উপায়

যদিও ডাক্তারের পরামর্শ সবসময় জরুরি, তবে কিছু ঘরোয়া উপায় আছে যা মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করতে পারে:

নিয়মিত ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য ঠিক থাকে এবং মাসিক নিয়মিত হতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম না করাই ভালো, কারণ এতে শরীরের ওপর বেশি চাপ পড়তে পারে।

স্বাস্থ্যকর খাবার

ফল, সবজি, এবং শস্য জাতীয় খাবার আপনার শরীরের জন্য খুবই জরুরি। ফাস্ট ফুড ও চিনি যুক্ত খাবার ত্যাগ করার চেষ্টা করুন।

পর্যাপ্ত ঘুম

প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে স্ট্রেস থেকে মুক্তি দেয় এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।

আদা

আদা মাসিকের সমস্যা কমাতে খুবই কার্যকরী। এটি প্রদাহ কমাতে এবং মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন আদা চা পান করতে পারেন।

দারুচিনি

দারুচিনি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং মাসিক নিয়মিত করে। এটি পিসিওএস-এর সমস্যাতেও উপকারী।

মাসিক নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)

মাসিক নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে, তাই না? এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:

মাসিক কতদিন বন্ধ থাকলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?

যদি আপনার বয়স ৪৫ বছরের কম হয় এবং ৩ মাসের বেশি সময় ধরে মাসিক বন্ধ থাকে, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।

মাসিক কি স্ট্রেসের কারণে বন্ধ হতে পারে?

হ্যাঁ, অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মাসিক বন্ধ হতে পারে।

পিসিওএস কি মাসিকের সমস্যা তৈরি করে?

অবশ্যই, পিসিওএস একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যা মাসিকের অনিয়মিততা বা বন্ধ হওয়ার কারণ হতে পারে।

মাসিক নিয়মিত করার জন্য কি কোনো ওষুধ আছে?

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত না। আপনার সমস্যার কারণ জেনে ডাক্তার সঠিক ওষুধ দিতে পারবেন।

মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে কি গর্ভবতী হওয়া যায়?

যদি মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ গর্ভধারণ না হয়, তাহলে ডিম্বাণু উৎপাদন না হওয়ার কারণে গর্ভবতী হওয়া কঠিন হতে পারে। তবে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

মাসিক বন্ধ হওয়ার কারণ এবং সমাধান – একটি টেবিল

এখানে একটি টেবিলে মাসিক বন্ধ হওয়ার কিছু কারণ এবং তার সম্ভাব্য সমাধান দেওয়া হলো:

কারণসম্ভাব্য সমাধান
গর্ভধারণপ্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
স্ট্রেস বা মানসিক চাপযোগা, মেডিটেশন, বা পছন্দের কাজ করে মন শান্ত রাখুন।
ওজন পরিবর্তনস্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং ধীরে ধীরে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।
পিসিওএসডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
থাইরয়েড সমস্যাথাইরয়েড পরীক্ষা করান এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলপিল পরিবর্তন করার জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তিডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাস্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা করান এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন।

শেষ কথা

মাসিক বন্ধ হওয়া নিয়ে চিন্তা না করে এর কারণ খুঁজে বের করা এবং সঠিক সমাধান নেওয়া জরুরি। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিন এবং কোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!

যদি আপনার মাসিক নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি চেষ্টা করব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে। আর হ্যাঁ, এই লেখাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!

Scroll to Top