ঘন ঘন মাসিক হলে কি করণীয়

ঘন ঘন মাসিক? টেনশন নয়, সমাধান আছে!

মাসিক বা পিরিয়ড নিয়ে আমাদের সমাজে এখনো অনেক লুকোছাপা। কিন্তু এটা তো শরীরের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাই না? প্রতি মাসে মেয়েদের শরীরে কিছু পরিবর্তন হয়, আর তারই একটা অংশ হলো এই মাসিক।
কিন্তু যদি দেখেন আপনার মাসিক চক্রটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে, মানে ঘন ঘন হচ্ছে, তখন একটু চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। “ঘন ঘন মাসিক হলে কি করণীয়” – এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই আপনার মনেও উঁকি দিচ্ছে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি সহজেই এর কারণ বুঝতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন।

সুচিপত্র

ঘন ঘন মাসিক হওয়ার কারণগুলো কী কী?

ঘন ঘন মাসিক হওয়ার কারণ

মাসিক কেন ঘন ঘন হয়, তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। একদম সাধারণ কিছু কারণ থেকে শুরু করে জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা – সবকিছুই এর জন্য দায়ী হতে পারে। চলুন, কারণগুলো একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:

হরমোনের তারতম্য: যখন শরীর তাল মেলাতে পারে না

হরমোন আমাদের শরীরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, এটা তো জানেনই। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক চক্রের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রোজেস্টেরন (Progesterone) নামের দুটি হরমোন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন এই হরমোনগুলোর মাত্রা স্বাভাবিক থাকে না, তখনই সমস্যা শুরু হয়।

  • বয়ঃসন্ধি: টিনএজ girls দের প্রথম প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার সময় হরমোনগুলো ঠিকমতো কাজ করতে একটু সময় নেয়। তাই প্রথম কয়েক বছর মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।
  • পেরিমেনোপজ: মেনোপজের কাছাকাছি সময়ে (সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর) হরমোনের মাত্রা কমতে শুরু করে। ফলে মাসিক চক্রে পরিবর্তন আসে এবং ঘন ঘন মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • থাইরয়েড সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড হরমোনের imbalance হলে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।

জীবনযাত্রার প্রভাব: আপনার দৈনন্দিন অভ্যাস কতটা দায়ী?

আমাদের লাইফস্টাইল বা জীবনযাপন পদ্ধতি শরীরের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। কিছু খারাপ অভ্যাস ঘন ঘন মাসিকের কারণ হতে পারে।

  • অতিরিক্ত স্ট্রেস: অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকলে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মাসিক irregular হয়ে যেতে পারে।
  • ওজন পরিবর্তন: হঠাৎ করে অনেক ওজন কমলে বা বাড়লে হরমোনের ওপর প্রভাব পড়ে এবং মাসিক irregular হতে পারে।
  • অতিরিক্ত ব্যায়াম: অতিরিক্ত exercise করলে শরীরে fat-এর পরিমাণ কমে যায়, যা হরমোন উৎপাদনে বাধা দেয়।

শারীরিক সমস্যা: শরীর জানান দিচ্ছে কোনো রোগ বাসা বেঁধেছে

কিছু শারীরিক সমস্যার কারণেও ঘন ঘন মাসিক হতে পারে। এই সমস্যাগুলো দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।

  • পিসিওএস (PCOS): পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (Polycystic Ovary Syndrome) একটি হরমোনজনিত সমস্যা, যা ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। এর কারণে অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত ওজন বাড়া এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • ফাইব্রয়েড: জরায়ুতে ফাইব্রয়েড (Fibroids) হলে অতিরিক্ত রক্তপাত এবং ঘন ঘন মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • এন্ডোমেট্রিওসিস: এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) হলে জরায়ুর ভেতরের কোষগুলো অন্য জায়গায়, যেমন ডিম্বাশয় বা পেটের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যায়। এর কারণে তলপেটে ব্যথা এবং অনিয়মিত মাসিক হতে পারে।
  • সংক্রমণ: পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (Pelvic Inflammatory Disease) বা অন্য কোনো infection থাকলে জরায়ুতে প্রদাহ হতে পারে, যা ঘন ঘন মাসিকের কারণ হতে পারে।

কী কী লক্ষণ দেখলে বুঝবেন এটা স্বাভাবিক নয়?

সব irregular মাসিক কিন্তু চিন্তার কারণ নয়। তবে কিছু লক্ষণ দেখলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

  • মাসিক চক্রের দৈর্ঘ্য: সাধারণত মাসিক চক্র ২৮ দিনের হয়, তবে ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হলেও সেটা স্বাভাবিক। যদি দেখেন আপনার মাসিক ২১ দিনের আগে হচ্ছে, তাহলে এটা চিন্তার বিষয়।
  • অতিরিক্ত রক্তপাত: মাসিকের সময় যদি খুব বেশি রক্তপাত হয় এবং এর কারণে দুর্বল লাগে, তাহলে ডাক্তার দেখানো উচিত।
  • ব্যথা: মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক নয়। যদি ব্যথার কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অসুবিধা হয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • অন্যান্য উপসর্গ: অনিয়মিত মাসিকের সাথে যদি অন্য কোনো উপসর্গ, যেমন – অতিরিক্ত চুল পড়া, ত্বকের সমস্যা বা ওজন পরিবর্তনের মতো লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান।

ঘন ঘন মাসিক হলে আপনি কী করতে পারেন?

যদি আপনার মাসিক ঘন ঘন হয়, তাহলে কিছু ঘরোয়া উপায় এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আপনি এই সমস্যা সমাধান করতে পারেন।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন: সুস্থ থাকার সহজ উপায়

জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে আপনি অনেকটাই সুস্থ থাকতে পারেন।

  • স্ট্রেস কমান: যোগা, মেডিটেশন বা পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমান।
  • স্বাস্থ্যকর খাবার: প্রচুর ফল, সবজি ও শস্য জাতীয় খাবার খান। ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন। তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।

ঘরোয়া টোটকা: যখন হাতের কাছেই সমাধান

কিছু ঘরোয়া উপায় আছে, যা মাসিক নিয়মিত করতে সাহায্য করতে পারে।

  • আদা: আদা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং মাসিকের ব্যথা কমায়। প্রতিদিন আদা চা পান করতে পারেন।
  • দারুচিনি: দারুচিনি রক্ত চলাচল বাড়াতে সাহায্য করে এবং মাসিক নিয়মিত করে। এটি খাবারের সাথে মিশিয়ে অথবা চা হিসেবে পান করতে পারেন।
  • মেথি: মেথি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। রাতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি পান করুন।
  • অ্যালোভেরা: অ্যালোভেরা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং মাসিক regular করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে অ্যালোভেরার জুস পান করতে পারেন।

ডাক্তারের পরামর্শ: কখন আর দেরি করা উচিত নয়

যদি ঘরোয়া উপায়গুলো কাজে না দেয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

  • হরমোন পরীক্ষা: ডাক্তার আপনার হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য কিছু টেস্ট দিতে পারেন।
  • আলট্রাসাউন্ড: জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ের অবস্থা জানার জন্য আলট্রাসাউন্ড করা হতে পারে।
  • চিকিৎসা: পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ডাক্তার আপনাকে ওষুধ বা অন্য কোনো চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। পিসিওএস, ফাইব্রয়েড বা অন্য কোনো সমস্যার জন্য আলাদা চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।

ঘন ঘন মাসিক নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)

মাসিক নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে, তাই না? এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:

প্রশ্ন ১: পিরিয়ড কত দিনে হয়?

সাধারণত পিরিয়ড ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত হতে পারে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এটা ২ দিন বা ৮ দিনও হতে পারে। যদি আপনার পিরিয়ড এর থেকে অনেক বেশি দিন ধরে চলে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন ২: মাসিক কি দুইবার হতে পারে?

হ্যাঁ, কোনো কোনো মাসে দুইবার মাসিক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এটা হতে পারে। তবে যদি এটা নিয়মিত হতে থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৩: মাসিক কত দিন পর পর হয়?

মাসিক সাধারণত ২৮ দিন পর পর হয়। তবে ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হলে সেটাও স্বাভাবিক। যদি ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পরে মাসিক হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৪: মাসিক না হওয়ার কারণ কি?

মাসিক না হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন – গর্ভাবস্থা, স্ট্রেস, ওজন পরিবর্তন, হরমোনের সমস্যা বা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা। কারণ জানতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৫: মাসিক নিয়মিত করার উপায় কি?

মাসিক নিয়মিত করার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা, স্ট্রেস কমানো এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিছু ঘরোয়া উপায়, যেমন – আদা, দারুচিনি ও মেথি ব্যবহার করেও উপকার পাওয়া যেতে পারে।

শেষ কথা: নিজের শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন

ঘন ঘন মাসিক হওয়াটা বিরক্তিকর হলেও, এর সমাধান আছে। প্রথমে কারণগুলো জানার চেষ্টা করুন, নিজের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, আপনার শরীর আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই এর যত্ন নেওয়া আপনার দায়িত্ব।

যদি এই ব্লগ পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!

Scroll to Top