ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া শরীরের একটি জটিল সমস্যা, যা সাময়িক বিরক্তির। তাই ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণগুলো বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন। যেকোনো বয়সে এটি ঘটতে পারে, এবং এর কারণগুলো হতে পারে একাধিক শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক।
ঘন ঘন প্রস্রাব শুধু শরীরের পানিশূন্যতার কারণ নয়, এটি অনেক সময় বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিরও ইঙ্গিত দেয়। নিচে সম্ভাব্য ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ কারণ এবং প্রতিরোধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ

১. মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI)
মূত্রনালীর সংক্রমণ (Urinary Tract Infection) মূত্রনালী এবং মূত্রাশয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের ফলে সৃষ্ট হয়। মূত্রনালীর সংক্রমণ কখনো কখনো কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে। নারীদের মধ্যে এটি সাধারণত বেশি দেখা যায়। কারণ তাদের মূত্রনালী তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ায় ব্যাকটেরিয়া সহজে প্রবেশ করতে পারে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ কেন হয়?
- অপর্যাপ্ত পানি পান
- ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ
- প্রস্রাবের সময় অনিয়ম বা মূত্র আটকে রাখা
- অপরিষ্কার প্যাড বা টয়লেট ব্যবহার
- ডায়াবেটিস বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- প্রচুর পানি পান করে মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
- প্রতিবার প্রস্রাব করার পর মূত্রনালী ভালোভাবে পরিষ্কার রাখা জরুরি।
- সংক্রমণ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত।
২. ডায়াবেটিস বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
ডায়াবেটিস হল ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ। ডায়াবেটিস হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে রক্তে শর্করার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এ সময় শরীর প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত শর্করা বের করার চেষ্টা করে, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
ডায়াবেটিস কেন হয়?
- জিনগত কারণ
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- হরমোনের অস্বাভাবিকতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
- ধূমপান ও মদ্যপান
- ইনসুলিনের অপর্যাপ্ত উৎপাদন
- ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম
- ওজন নিয়ন্ত্রণ
- পর্যাপ্ত পানি পান
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার
- নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা
- সুষম খাদ্য গ্রহণ
- শারীরিক ব্যায়াম
- ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা
- জীবনধারায় পরিবর্তন
৩. প্রস্টেটের বৃদ্ধি
বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি প্রায়ই ঘটে। প্রস্টেটের বর্ধন মূত্রনালীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে মূত্রাশয় সম্পূর্ণ খালি করতে সমস্যা হয়। এটি প্রস্রাবের প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি কেন হয়?
- বয়স বৃদ্ধির সাথে প্রস্টেটের প্রাকৃতিক বৃদ্ধি।
- জিনগত কারণ।
- হরমোনের পরিবর্তন।
- টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি
- ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- শারীরিক কার্যকলাপের অভাব
- ধূমপান ও মদ্যপান
- ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ইতিহাস
প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- প্রয়োজনে প্রস্টেটের আকার ছোট করার জন্য অস্ত্রোপচার।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- নিয়মিত ব্যায়াম
- পর্যাপ্ত পানি পান
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- ওষুধ গ্রহণ (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)
- হরমোন থেরাপি
- প্রাকৃতিক সম্পূরক ও ভেষজ চিকিৎসা (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)
৪. মূত্রাশয়ের অতিসক্রিয়তা
মূত্রাশয়ের অতিসক্রিয়তা (Overactive Bladder) এমন একটি অবস্থা, যেখানে মূত্রাশয় অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংকুচিত হয়, যার ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন হয়। এটি বিশেষত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, এবং মানসিক চাপ, স্নায়ুর সমস্যা, বা দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের কারণে হতে পারে।
মূত্রাশয়ের অতিসক্রিয়তা কেন হয়?
- মূত্রাশয়ের পেশির দুর্বলতা
- স্নায়ুর সমস্যা (যেমন: পারকিনসন’স রোগ, স্ট্রোক)
- দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ
মূত্রাশয়ের অতিসক্রিয়তা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- মূত্রাশয়ের প্রশিক্ষণ বা ব্ল্যাডার ট্রেনিং (Bladder Training)।
- কেগেল ব্যায়ামের মাধ্যমে মূত্রাশয়ের পেশি শক্তিশালী করা।
- প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন।
৫. গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব
গর্ভাবস্থার সময় মাতৃগর্ভের শিশুর বৃদ্ধি মূত্রাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে প্রস্রাবের ঘন ঘন তাগিদ অনুভূত হয়। প্রথম ত্রৈমাসিকের হরমোন পরিবর্তনও মূত্রাশয়ের পেশিগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে, যার ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা দেখা যায়।
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব কেন হয়?
- হরমোনের পরিবর্তন।
- রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি
- বাচ্চার বৃদ্ধির কারণে মূত্রথলির উপর চাপ
- অতিরিক্ত পানি পান
- শরীরের অতিরিক্ত তরল নির্গমন
- বাচ্চার অবস্থানের পরিবর্তন
- কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি
- গর্ভাশয়ের সম্প্রসারণ
- দেহের মেটাবলিক রেট বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিরোধ:
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস।
- রাতের বেলায় বেশি পানি পান না করা।
৬. স্নায়বিক সমস্যা এবং মানসিক চাপ
স্নায়বিক সমস্যা কীভাবে ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ হয়?
স্নায়ুর সমস্যা মূত্রাশয়ের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে, যা ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে স্ট্রোক, মেরুদণ্ডের আঘাত, বা নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারগুলোর কারণে মূত্রনালীতে নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রবণতা দেখা যায়।
স্নায়বিক সমস্যা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন এবং ব্যায়াম।
- প্রয়োজন হলে চিকিৎসা বা ফিজিওথেরাপি করা।
ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিরোধের কৌশল

১. পানি পান নিয়ন্ত্রণ
যথেষ্ট পানি পান করা মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। তবে অতিরিক্ত পানি পান করলে প্রস্রাবের তাগিদ বেড়ে যেতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে পারেন। কিন্তু রাতে শোবার আগে অতিরিক্ত পানি না পান করলে প্রস্রাবের কারণে ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
২. কফি এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা
কফি এবং অ্যালকোহল ডাইরেটিক হিসেবে কাজ করে, যা শরীরে পানিশূন্যতার সৃষ্টি করে এবং প্রস্রাবের প্রয়োজন বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত চা, কফি বা অ্যালকোহল গ্রহণ করলে ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের পানীয় কমিয়ে দেওয়া ভালো।
৩. মূত্রাশয়ের প্রশিক্ষণ (Bladder Training)
মূত্রাশয়ের প্রশিক্ষণ একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মূত্রাশয়ের স্বাভাবিক কাজের উন্নতি করা যায়। এতে প্রতি ২ ঘণ্টা পর পর প্রস্রাব করার অভ্যাস গড়ে তোলা হয়, এবং সময়ের ব্যবধান ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়। এই প্রশিক্ষণ মূত্রাশয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
যদি ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হয় এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ সুনির্দিষ্ট না হয়, তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক মূত্রনালীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং রোগ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা পরামর্শ দিতে পারেন।
ব্রণের দাগ দূর করার উপায়: ৫টি গোপন টিপস, ত্বক হবে ঝকঝকে
উপসংহার
ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা জীবনের মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণগুলি নির্ধারণ করে সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যদি ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর হয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সময়মতো চিকিৎসা ও সঠিক পদক্ষেপ নিলে এ সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব।